রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের চিত্র আজকের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। কোলের অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে মায়ের অসহায় আর্তি—“সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনেছি”—শুধু একটি ব্যক্তিগত কষ্টের বর্ণনা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের চরম ঘাটতির প্রতীক।
একটি হাসপাতাল যেখানে ৯৫টি শয্যার ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে একসঙ্গে ৩১৫ শিশুর ভর্তির ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম নয়। বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থা, সীমাবদ্ধতা এবং পরিকল্পনার ঘাটতির নগ্ন প্রকাশ। চিকিৎসা মানেই শুধু ডাক্তার-নার্স নয়, প্রয়োজন পর্যাপ্ত অবকাঠামো, ওষুধ ও প্রশাসনিক দক্ষতা—যার সবগুলো ক্ষেত্রেই ঘাটতি প্রকট।
ওষুধের সংকট নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাধারণত দায় এড়িয়ে চলে প্রশাসনিক জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু একজন দরিদ্র মা, যিনি সন্তানের জীবন বাঁচাতে দৌড়ে এসেছেন, তিনি কীভাবে এই ‘রেকর্ডে নাম ওঠার নিয়ম’ বুঝবেন? তার কাছে জরুরি বিষয় কেবল সন্তানকে সুস্থ করা, নিয়মকানুন নয়।
এর চেয়েও বেদনাদায়ক হলো—রংপুরে ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল পাঁচ বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে। জরুরি বিভাগ, আউটডোর, অপারেশন থিয়েটার, ল্যাব, ওয়ার্ড ও কেবিন—সব সুবিধা প্রস্তুত থাকলেও শুধু ফাইল আটকে থাকার কারণে হাসপাতালটি চালু হচ্ছে না। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের স্বার্থসিদ্ধি ও প্রশাসনিক গাফিলতি এখানে বড় ভূমিকা রাখছে বলেই অভিযোগ উঠেছে। যদি সত্যি হয়, তবে এটি কেবল দুর্নীতি নয়—একটি প্রজন্মের স্বাস্থ্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতারণা।
রংপুর অঞ্চলের শিশু চিকিৎসা এখন তীব্র চাপের মুখে। এর সমাধানে অবিলম্বে নতুন হাসপাতালটি চালু করা, ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগী ও স্বজনদের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। মানুষকে জানতে হবে, তারা কোন সুবিধা পাওয়ার কথা এবং কীভাবে তা দাবি করতে হবে।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না—শিশুদের চিকিৎসা শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যতে বিনিয়োগ। সেই বিনিয়োগ অবহেলায় নষ্ট হলে তার ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়। আজকের অব্যবস্থার দায়ভার কেবল একটি হাসপাতালের নয়—এটি গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। তাই শিশুস্বাস্থ্যের সংকট সমাধানকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা ছাড়া বিকল্প নেই।