লায়ন মোঃ আবুল হাশেম
ঐতিহাসিক পটভূমি : আধুনিক ক্রেডিট কার্ডের পূর্বসূরি হিসেবে ১৯২৮ সালে দ্য চারগা প্লেট (The Charga Plate) নামে একটি যন্ত্র তৈরি করা হয়। এটি ছিল একটি আয়তাকার ধাতুর শিট, যা তখনকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত গ্রাহকগণকে প্রদান করতেন। সেগুলো দেখতে বর্তমান সময়ের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কার্ডের মত ছিল। ১৯৩৪ সালে আমেরিকান এয়ারলাইন্স এবং এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশন গ্রাহকদের বিমানের টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ‘Buy Now and Pay Later’ এর সুবিধা প্রদান করার জন্য এয়ার ট্রাভেল কার্ড চালু করে। ১৯৫০ সালে ডাইনার্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (Diners Club International) এর দুই প্রতিষ্ঠাতা রালফ্ স্নাইডার ও ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা প্রথমবারের মতো যেকোনো জায়গায় ব্যবহারের জন্য চার্জ কার্ড তৈরি করেন। ১৯৫৮ সালে ব্যাংক অব আমেরিকা “ব্যাংক আমেরিকা কার্ড” নামে একটি আধুনিক ক্রেডিট কার্ড চালু করে, যা সর্বত্র গ্রহণযোগ্য ছিল। ১৯৬৬ সালে আমেরিকা কার্ডের প্রতিযোগী হিসেবে “মাস্টার চার্জ” নামে আরও একটি কার্ড চালু করে, যা বর্তমানে মাস্টার কার্ড নামে পরিচিত। ১৯৭৬ সালে ব্যাংক আমেরিকা কার্ডের নাম পরিবর্তন করে ভিসা রাখা হয় আর আশির দশকে ক্রেডিট কার্ডে ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ যুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে কার্ডে ইএমভি চিপ (EMV Chip) প্রযুক্তি যোগ করা হয়। এভাবেই কার্ড ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে বর্তমানের ক্রেডিট কার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে।
কার্ডের কার্যকারিতা : ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে গ্রাহকের জন্য প্লাস্টিকের তৈরি যে কার্ড ইস্যু করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ড হলো এক বিশেষ ধরনের “দায় পরিশোধ কার্ড”। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্ডের বাহকের জন্য একটি নির্দিষ্ট ঋণ সীমার ঘূর্ণায়মান তহবিল (Revolving Account) সৃষ্টি করে। একজন ক্রেডিট কার্ড বাহক যখন কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য নগদ অর্থের পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করেন, তখন সে ব্যাংক থেকে এক ধরনের দ্রুত ঋণ (Quick Loan) নিয়ে থাকেন। সাধারণত ক্রেডিট কার্ডে গ্রাহকের নাম, ইস্যুকারীর নাম, ইউনিক কার্ড নম্বরসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে। এটির অপর পিঠে এক ধরনের ম্যাগনেটিক বা ইলেকট্রনিক চিপ থাকে, যা থেকে সংশ্লিষ্ট মেশিনগুলো তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। বিক্রেতা কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে তার বিক্রিত পণ্য বা সেবার মূল্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে কার্ডের বাহক একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কার্ডের বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে ক্রয়কৃত পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করেন।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধাদি : ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে এটির ক্রেডিট সীমা (Credit Limit) পরিবর্তিত হয়ে থাকে। ক্রেডিট সীমা হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ কত পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। ব্যাংক গ্রাহকের মাসিক ও বাৎসরিক আয়ের বিবরণী মূল্যায়ন করে ক্রেডিট সীমা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ব্যাংক গ্রাহকের অনাদায়ী দেনা অথবা ক্রেডিট ঋণ কতটুকু রয়েছে তা দেখার জন্য ডেট বারডেন রেশিও (Debt Burden Ratio) বিশ্লেষণ করে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (Credit Information Bureau) হতে গ্রাহকের লোন রিপোর্ট সংগ্রহ করে। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংক গ্রাহককে একটি ক্রেডিট স্কোর প্রদান করে এবং ক্রেডিট সীমা নির্ধারিত হয়। যাদের স্কোর বেশী থাকে তাদের ক্রেডিট সীমা বেশী দেয়া হয়। অন্যদিকে, যাদের স্কোর কম থাকে তাদের সীমা কম হয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডই প্রদান করে না। একজন ব্যক্তি চাইলে ব্যাংকে রাখা তার স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড্ ডিপোজিট (FDR) থেকেও ক্রেডিট কার্ড নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংক কোনো ধরনের ক্রেডিট স্কোর মূল্যায়ন করে না।
একজন গ্রাহক যখন পণ্য ক্রয় করত: ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মূল্য পরিশোধ করেন, তখন কার্ডের তথ্য কার্ড নেটওয়ার্ক প্রদানকারীর মাধ্যমে ব্যাংকে পাঠানো হয়। যদি ব্যাংক সেই লেনদেনটি অনুমোদন করে তবে ব্যাংক কার্ডের পক্ষে বিক্রেতাকে পেমেন্ট করে এবং কার্ডের অবশিষ্ট অর্থ থেকে সমপরিমাণ টাকা কমিয়ে ব্যালেন্স ঠিক করে দেয়। প্রতিটি ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট বিলিং সাইকেল পেরিয়ড (Billing Cycle Period) থাকে। ব্যাংক সেই সময়ে কার্ড বাহককে লেনদেনের একটি বিবরণী পাঠিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার ব্যবহৃত অর্থ (ঋণ) পরিশোধ করার জন্য নির্দেশনা দেয়। ঋণ পরিশোধ করার এই নির্দিষ্ট সময়কে সুদমুক্ত সময় বা গ্রেস পেরিয়ড (Grace Period) বলা হয়। সাধারণত গ্রেস পেরিয়ড ১৫ থেকে ৪৫ দিন হয়। যদি গ্রাহক গ্রেস পিরিয়ডের মধ্যে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেয়, তাহলে ব্যাংক তার কাছ থেকে কোনো সুদ নেয় না। ক্রেডিট কার্ডের বিলে তিনটি অংশ থাকে আর সেগুলো হলো: স্টেটমেন্ট ব্যালেন্স (Statement Balance), কারেন্ট ব্যালেন্স (Current Balance) এবং মিনিমাম ডিউ (Minimum Due)। গ্রাহক এই তিনটির যে কোনো একটি পরিশোধ করতে পারবেন। স্টেটমেন্ট ব্যালেন্স দ্বারা কার্ড ব্যবহার করে গ্রাহকের মোট খরচের পরিমাণ বুঝায়। অন্যদিকে, কারেন্ট ব্যালেন্স হচ্ছে শুধুমাত্র শেষ বিলিং সাইকেলে খরচ করা অর্থ। মিনিমাম ডিউ হলো ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা সর্বনিম্ন পরিমাণ, সাধারণত এটি স্টেটমেন্ট ব্যালেন্সের ১-৩% হয়ে থাকে। গ্রাহক গ্রেস পেরিয়ডের মধ্যে মিনিমাম ডিউ পরিশোধ করলে তিনি আর খেলাপি হবেন না। অবশিষ্ট বিল পরবর্তী বিলিং সাইকেলের সাথে যুক্ত হয় এবং ব্যাংক এই অবশিষ্ট টাকার উপর সুদ আরোপ করে। ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার অন্যান্য ঋণের তুলনায় অনেক বেশী, কারণ ক্রেডিট কার্ড কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই গ্রাহককে ঋণ প্রদান করে। ক্রেডিট কার্ড ডটকম এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ক্রেডিট কার্ডের বৈশ্বিক গড় সুদের হার ছিল ১৬.১৬%। কার্ডের সুবিধাগুলো হলো-
≈ বৈশ্বিক বৈধতা : বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। যারা প্রায়ই বিদেশে যাতায়াত করেন, তাদের জন্য ক্রেডিট কার্ড বহন করা বেশি সুবিধাজনক। কারণ ভিসা, মাস্টারকার্ড এবং অ্যামেক্স এর মতো কার্ড ইস্যুকারীদের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে কার্ডগুলো সকল আন্তর্জাতিক পস টার্মিনাল (POS Terminal) এবং এটিএম (ATM)-এ গৃহীত হয়। বাংলাদেশের কার্ড বাহকদের পাসপোর্ট থাকলে তারা যে কোনো দেশের দ্বৈত মুদ্রা বা ডাইনামিক কারেন্সির জন্য কার্ড ইস্যুকারীদের নিকট আবেদন করতে পারেন।
≈ EMI সুযোগ : একজন মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তার বড় খরচকে ছোট ছোট মাসিক কিস্তিতে রূপান্তর করে নিতে পারেন। এতে তার সঞ্চয়ের টাকা খরচ করার প্রয়োজন হয় না। ব্যাংক বাজারের তথ্যমতে, কোনো কিছু কেনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঋণের থেকে ক্রেডিট কার্ডের ইএমআই (EMI) ব্যবহার করা অধিক লাভজনক। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং রিটেইলার তাদের বিক্রয়কে ত্বরান্বিত করার জন্য ব্যাংকের সাথে ০% ইএমআই সুবিধা দিয়ে চুক্তি করে। ফলে গ্রাহকেরা বাড়তি সুদের ঝুঁকি ছাড়া খরচটিকে কয়েকটি কিস্তিতে ভাগ করে নেন। এছাড়া গ্রাহক যে কোনো ক্রেডিট কার্ড কেনার সময় ব্যাংকের কিছু শর্ত পূরণে সহজেই ইএমআই সুবিধা নিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে গ্রাহকের মোট পেমেন্টের উপর ব্যাংক সুদ আরোপ করে। যেমন- বাংলাদেশে অ্যামেক্স ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী ৩,০০০ টাকার বেশি কোনো কিছু ক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহক সেবায় ফোন দিয়ে খরচটিকে ইএমআই-তে রূপান্তর করে নিতে পারেন।
≈ ফ্রি লোন ও গ্রেস পেরিয়ড : ব্যাংক তার গ্রাহককে ক্রেডিট কার্ড প্রদানের মাধ্যমে মূলত লাইন অব ক্রেডিট (Line of Credit) বা ফ্রি ঋণ দিয়ে থাকে। গ্রাহক এই ঋণ পরিশোধের জন্য গ্রেস পেরিয়ড পায়। অনেক গ্রাহক এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে স্বল্প মেয়াদে বিভিন্ন বন্ড, স্টক মার্কেট বা স্কিমে বিনিয়োগ করে এবং গ্রেস পেরিয়ড শেষ হবার আগেই কার্ডের বিল পরিশোধ করে দেয়। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মুনাফার পরিমাণ খুবই সামান্য, তবে ফ্রি টাকা ব্যবহার করে এভাবে মুনাফা করা বেশ লাভজনক পদ্ধতি।
≈ বীমার আওতাভুক্তি : অনেক ক্রেডিট কার্ডে গ্রাহকদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত (Pre Installed) বীমার সুবিধা (জীবন বীমা, অটো বীমা, যাতায়াত বীমা, পণ্য বীমা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন- সিটি ব্যাংক তাদের অ্যামেক্স গোল্ড কার্ড বাহকদের ডাবল বেনিফিট বীমা (Double Benefit Insurance) প্রদান করে। এ বীমার আওতায় যদি কোনো ক্রেডিট কার্ড বাহক মারা যান বা পূর্ণ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন, তাহলে ঐ গ্রাহকের অনাদায়ী ঋণের পুরোটাই মওকুফ করে দেয় এবং সমপরিমাণ টাকা তার নমিনিকে প্রদান করা হয়। এই বীমার আওতায় গ্রাহককে তার মাসিক স্টেটমেন্টের ০.৪% বীমার প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। বীমা সুবিধার আওতায় ব্যাংকগুলো কার্ড বাহককে হাসপাতালের বিল কমানোসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সুবিধা দিয়ে থাকে।
≈ ভালো ক্রেডিট স্কোর : ভালো একটি ক্রেডিট স্কোর তৈরিতে ক্রেডিট কার্ড বেশ সুবিধাজনক উপায়। গ্রাহক যদি সঠিক সময়ে তাদের ক্রেডিট বিল পরিশোধ করতে পারেন, তবে সেটি তার ক্রেডিট বিবরণী/ইতিহাসে যুক্ত হয় এবং সবশেষে ভালো ক্রেডিট স্কোর ইমেজ তৈরি করে। গ্রাহক যদি ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঋণ নিতে চায় তাহলে এই ক্রেডিট স্কোরের সাহায্যে খুব সহজে ঋণ নিতে পারে।
≈ পুরস্কার ও অগ্রাধিকার সেবা : ক্রেডিট কার্ডের একটি লোভনীয় বিষয় হচ্ছে রিওয়ার্ড পয়েন্টস্ (Reward Points) ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা। বেশ কিছু নির্দিষ্ট দোকান, হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করলে ব্যবহারকারীদের পুরস্কার হিসেবে পয়েন্ট দেওয়া হয়। এই পুরস্কার পয়েন্ট ব্যবহার করে তারা গিফট্ কার্ড, ভ্রমন প্যাকেজ অথবা মারচেন্ডাইজ পণ্য পেতে পারেন। কিছু কার্ড আবার এয়ার মাইলস্ প্রদান করে, যা এয়ার টিকেট কিনতে ব্যবহার করা হয়। ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারীরা বিভিন্ন মার্চেন্ট এবং দোকান মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ক্যাশ ফেরত, অতিরিক্ত মূল্য ছাড় এবং একটি কিনলে আরেকটি ফ্রিসহ আরো অনেক ধরনের অফার দিয়ে থাকে। এছাড়া বিদেশ ভ্রমনের ক্ষেত্রে অনেক ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী অগ্রাধিকার পাসের মাধ্যমে বিমানবন্দরে আনা এবং নেওয়া (Pick & Drop), দেখা এবং অভ্যর্থনা (Meet & Greet) এবং লাউঞ্জ সুবিধা দেয়। বাংলাদেশে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক তাদের কার্ড ব্যবহারকারীদের জন্য এই ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে।
≈ ডেবিট কার্ড অপেক্ষা নিরাপদ : ক্রেডিট কার্ড ডেবিট কার্ড অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ। গ্রাহক ডেবিট কার্ড দিয়ে টাকা উত্তোলন অথবা কোনো কিছু ক্রয় করতে গেলে সরাসরি তার ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা পরিশোধ করা হয়। ফলে কোনো গ্রাহকের ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের জালিয়াতি লেনদেনের সকল দায়বদ্ধতা ব্যবহারকারীর উপরে থাকে। যদিও তদন্ত শেষে ব্যাংক হয়তো এই টাকা ফেরত দিতে পারে কিন্তু তা বেশ সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডে যে কোনো প্রকার জালিয়াতির জন্য ব্যবহারকারী দায়বদ্ধ থাকে না। বরং ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারীর দায়িত্ব থাকে এসব সমস্যা সমাধানের। এছাড়াও ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী এবং ব্যাংকগুলো চার্জ ব্যাক, লেনদেন অ্যালার্ট এবং কনফার্মেশনসহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে জালিয়াতি থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করে।
ক্রেডিট কার্ডের অসুবিধাসমূহ : ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে যেমন অনেক সুবিধা পাওয়া যায় তেমনি ইহার কিছু অসুবিধাও বিদ্যমান। এরূপ অসুবিধাগুলোর মধ্যে নিম্নে উল্লেখিতগুলো প্রধান :
≈ উচ্চহারে সুদ আরোপ : যে কোনো ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার অনেক বেশি। দৈনিক ডেইলি স্টারের একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের জন্য সুদের হার সর্বোচ্চ ২০% নির্ধারণ করে দেয়; যেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যক্তিগত ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯%। যদি কোনো গ্রাহক সঠিক সময়ে ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তবে তাকে অনেক বেশি পরিমাণে সুদ প্রদান করতে হয়। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে নগদ টাকা উত্তোলন করা হলে গ্রাহককে অনেক উচ্চ হারে ফি প্রদান করতে হয়।
≈ অপ্রয়োজনীয় খরচ : ক্রেডিট কার্ড যেহেতু এখন কিনুন পরে পেমেন্ট করুন ( Buy Now Pay Later) সুবিধা দেয়, তাই অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহক অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, যখন একজন ব্যক্তি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন তখন তিনি নগদ অর্থের তুলনায় ১১৩% বেশি অর্থ খরচ করে থাকেন।
≈ লুকায়িত বিভিন্ন চার্জ : ক্রেডিট কার্ডে অনেক ধরনের লুকায়িত চার্জ/ফিস থাকে। যেমন- প্রসেস ফি (Processing Fee), বীমা ফি (Insurance Fee), বার্ষিক ফি (Annual Fee), রক্ষণাবেক্ষণ ফি (Maintenance Fee), অগ্রিম নগদ ফি (Cash Advance Fee), সীমা অতিক্রম চার্জ (Limit Exceeding Charge), জিএসটি চার্জ (GST Charge), বৈদেশিক লেনদেন ফি (Foreign Transaction Fee), ডিজঅনার ফি (Dishonor Fee), নগদ উত্তোলন ফি (Cash Withdrawal Fee), মার্ক আপ ফি (Markup Fee), লেট পেমেন্ট ফি (Late Payment Fee), ব্যালেন্স ট্রান্সফার ফি (Balance Transfer Fee), পেপার স্টেটমেন্ট ফি (Paper Statement Fee) এবং এসএমএস ফি (SMS Fee) এর মতো আরো অনেক কিছু। এছাড়া অনাদায়ী বিলের উপর ভ্যাট (VAT) আরোপ করা হয়।
≈ নিম্নহারে ক্রেডিট স্কোর : সঠিক সময়ের মধ্যে ক্রেডিট বিল পরিশোধ করতে না পারলে কার্ড বাহকের ক্রেডিট স্কোর কমে যায় এবং এই রেকর্ড তার ক্রেডিট ইতিহাসে থেকে যায়। নিম্ন ক্রেডিট স্কোর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে প্রভাব ফেলে। ফলে গ্রাহক যদি ভবিষ্যতে অন্য কোনো ঋণ নিতে চান, তখন এই ব্যক্তিগত ক্রেডিট ইতিহাসের কারণে তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা : ২০২১ সালের আগস্ট মাসের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৮০ কোটির বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ১০১ কোটিরও বেশি ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়। শিফট্ প্রসেসিং (Shift Credit Card Processing) এর তথ্যসূত্র মতে, আমেরিকাতে ১০৬ কোটির বেশি ক্রেডিট কার্ড সচল রয়েছে। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৭০% মানুষ অন্তত একটি, ৩৪% মানুষ অন্তত তিনটি এবং ১৪% মানুষ অন্তত দশটি করে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। অপরদিকে, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৬ লক্ষেরও বেশি মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র ১% মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন।
ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী এবং ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্ক প্রদানকারীদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বেশিরভাগ ক্রেডিট কার্ডই ব্যাংক ইস্যু করে। অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্ক প্রদানকারীরা ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের জন্য নেটওয়ার্ক অবকাঠামো প্রদান করে। চারটি প্রধান আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্ক প্রদানকারী হলো ভিসা, মাস্টার কার্ড, ডিসকভার এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস। তাদের মধ্যে প্রায় ৫২.৮০% মার্কেট শেয়ার নিয়ে ভিসা বিশ্বের প্রধান নেটওয়ার্ক প্রদানকারী। অন্যদিকে ৩১.৬০%, ৮.১০% এবং ৭.৫০% মার্কেট শেয়ার নিয়ে মাস্টার কার্ড, ডিসকভার এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। তবে ডিসকভার এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস এই দুটি প্রতিষ্ঠান একইসাথে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু এবং নেটওয়ার্ক প্রদান করে।
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা : বর্তমানে আমেরিকা হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্রেডিট কার্ড বাহক দেশ। আমেরিকাতে অনেকেই বেতন পাবার পূর্বেই বিভিন্ন খরচ করে থাকেন। তাই আমেরিকাতে ক্রেডিট কার্ড খুবই জনপ্রিয়। স্ট্যাটিসটা (Statista) এর তথ্যসূত্র মতে, ২০২০ সালে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দিক থেকে কানাডা বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করেছিল। দেশটির ৭৮% মানুষের কাছে একটি ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এছাড়া জাপান, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের হার তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশেও ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ১১% বৃদ্ধি পেয়ে ১৭.৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া ২০২০ সালের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন প্রায় ১১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপসংহার : ক্রেডিট কার্ড হচ্ছে বিশ্বব্যাপী লেনদেনের একটি অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরনের মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক মানুষই নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তার সুবিধাগুলো উপভোগ করছেন। অপরদিকে কিছু মানুষের ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা থাকার কারণে এবং তাদের ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এটা নিতে ও ব্যবহার করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সঠিক পথে ত্বরান্বিত হলে ও মানুষের মাথাপিছু আয় এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তাদের মধ্যেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সম্ভাবনা দিন দিন আকর্ষণীয় হওয়ার আশা করা যায়।
<<<><><>>>
লেখক : এডিশনাল ডাইরেক্টর (অব.), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক।