৫ আগস্ট: গণঅভ্যুত্থানের গল্প—বাংলাদেশের নতুন অভিযাত্রা

প্রস্তাবনা

আজ ৫ আগস্ট। এক বছর আগে এই দিনে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। ভেঙে পড়েছিল ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে টানা ৩৬ দিনের আন্দোলন এনে দিয়েছিল এক নতুন ভোর—বাংলাদেশ ২.০-এর সূচনা। সেই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়, এটি ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই, বৈষম্যবিরোধী এক অগ্নিঝরা আন্দোলনের পূর্ণতা।

পটভূমি: কিভাবে শুরু হলো এই যাত্রা

সবকিছুর শুরু কোটা সংস্কার দাবিতে ছাত্র আন্দোলন দিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আন্দোলনের স্লোগান হয়ে ওঠে প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে—“বৈষম্য নয়, সমতার বাংলাদেশ চাই”
দিন গড়াতে গড়াতে এ আন্দোলন ছাত্রদের সীমা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে সর্বজনীন। রাজপথে নেমে আসে শিক্ষক, পেশাজীবী, চাকুরিজীবী থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ। এক হয়ে যায় মায়েরা, যারা এতদিন সন্তানকে রক্ষা করতে ঘরে রেখেছিলেন; বাবারা, যারা সন্তানকে ফিরতে বলেছিলেন।

অভ্যুত্থানের দিন: ৫ আগস্টের সকাল

সকাল থেকেই থমথমে ঢাকার আকাশ। প্রতিটি মোড়ে পুলিশি নজরদারি। কিন্তু দুপুরের পর চিত্র বদলাতে শুরু করে। ১১টার পর থেকে ঢাকামুখী মানুষের ঢল বাড়তে থাকে। দুপুর নাগাদ এই ঢল পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
গণভবন, সংসদ ভবন, শাহবাগ—সব জায়গা মানুষে পরিপূর্ণ। কেউ হাতে লাল-সবুজের পতাকা, কেউ মাথায় লাল কাপড় বেঁধে নেমেছেন রাজপথে।

ক্ষমতার পতন: এক স্বৈরাচারের পালিয়ে যাওয়া

এক পর্যায়ে গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্ধত কণ্ঠে একদা বলেছিলেন “শেখ হাসিনা পালায় না”, সেই তিনিই বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বিমান বাহিনীর এমআই‑১৭ হেলিকপ্টারে গণভবন থেকে যাত্রা করেন।
প্রথমে বঙ্গবন্ধু বিমানঘাঁটিতে, পরে সি‑১৩০ হারকিউলিসে করে ভারতের গাজিয়াবাদে পাড়ি জমান।

দুপুরে যখন গুঞ্জন ছড়াতে শুরু করে যে সরকারপ্রধান দেশ ছেড়েছেন, তখন জাতি অপেক্ষা করছিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। অবশেষে বিকেল ৩টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। নিশ্চিত করেন শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর।
তখনই দেশের প্রতিটি প্রান্তে বয়ে যায় বিজয়ের উল্লাস।

বিজয়ের উল্লাস বনাম রক্তক্ষয়

গণভবনে তখন প্রবেশ করেছে ছাত্র-জনতার জনসমুদ্র। কেউ নামাজে সেজদা দিচ্ছেন, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, কেউ আনন্দে লাফিয়ে উঠছেন। পাশের লেকে নেমে গোসল করছেন হাজার হাজার মানুষ। সংসদ ভবনেও উচ্ছ্বাসের জোয়ার।
তবে এই বিজয়ের মধ্যেই ঢাকার যাত্রাবাড়ি, আশুলিয়ার মতো এলাকায় ঘটে ভয়াবহ সহিংসতা। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। শুধুমাত্র যাত্রাবাড়িতেই মারা যায় ৫৫ জনের বেশি মানুষ। আশুলিয়ায় পুড়িয়ে মারা হয় আরও ছয়জনকে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নতুন সূচনা

সন্ধ্যার পর সেনাপ্রধান ঘোষণা দেন—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে নেওয়া হয় নতুন দিকনির্দেশনা।
এভাবেই জন্ম নেয় “বাংলাদেশ ২.০”—একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন।

সমাপ্তি: এক প্রজন্মের বিজয়

এই প্রজন্ম ১৯৭১ দেখেনি, কিন্তু তারা রচনা করেছে ইতিহাস। তারা প্রমাণ করেছে—জনগণের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। ৫ আগস্ট তাই শুধু একটি তারিখ নয়, এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক।
যতদিন থাকবে এ দেশ, ততদিন উচ্চারিত হবে এই স্লোগান:
“গণতন্ত্রের পথে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে—৫ আগস্ট আমাদের গৌরবের দিন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *