obak
23rd May 2022 6:02 pm | অনলাইন সংস্করণ
বঙ্গবন্ধুকে দেখা – হামিদুল আলম সখা
১৯৭৩ সাল। সদ্য স্বাধীন হয়েছে।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের সংবিধান,রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠন করাসহ রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধান করেছেন।
তখন বাংলাদেশে ১৯ জেলা ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। রাস্তাঘাট,পুল,ব্রীজ সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করলেন।ট্রুর করছিলেন। বিশেষ করে পুরানো জেলাগুলি।সেই কর্মসূচির মধ্যে ছিল ময়মনসিংহ।সার্কিট হাউস মাঠে বিরাট জনসভা।তারিখ মনে নেই।তবে আমরা স্কুল থেকে সবাই বিকাল তিনটার পূর্বেই মাঠে হাজির। সার্কিট হাউস ময়দানে বিশাল নৌকার আদলে মন্চ করা হয়েছে।সারা মাঠে লোকে লোকারণ্য।আমরা মহিলাদের পাশে জায়গা করে নিলাম। বঙ্গবন্ধুকে মন্চে উঠালেন স্থানীয় নেতারা।বিশাল মানুষটাকে নিজের চোখে দেখলাম। বক্তব্য শুনলাম।কি দরাজ কন্ঠ। অভিভূত হলাম।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা -২
১৯৭১সালের ৭মাচ বঙ্গবন্ধু যে অবিস্মরণীয় বক্তব্য দিয়েছেন শুধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নয় সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। আব্রাহাম লিংকন,মহামতি লেনিন,মাও সে তুং এর বক্তব্য কে হার মানিয়েছে।তাঁর অঙ্গলি হেলনে সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বাঙালি জাতির দু’টি বড় অর্জন এক.রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা দুই.বাংলাদেশের স্বাধীনতা।এ দু’টি অর্জন করতে গিয়ে বীর বাঙালী দের জীবন দিতে হয়েছে,রক্ত দিতে হয়েছে।আর এ দুটি অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অবদান ছিল ব্যাপক। বিশেষ করে দ্বিতীয় টিতে তাঁর অবদানের কথা বাঙালি জাতি অস্বীকার করতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা -৩
১৯৬৯ সালে আমরা বড় ভাইদের সাথে ময়মনসিংহের রাজপথে শ্লোগান দিয়েছি।জেলের তালা ভাংবো, শেখ মুজিব কে আনবো,জেগেছে জেগেছে বীর বাঙালী জেগেছে, তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা মেঘনা যমুনা,ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ,জয় বাংলা।
ঊনসত্তরে আইয়ূব খানের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন ময়মনসিংহের মিন্টু,খুলনার হাদিস আর ঢাকার আসাদসহ অনেকেই। ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বাঙালির নেতা শেখ মুজিব সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা মুক্তি পেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনাকীর্ণ সভায় ঢাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ জনতার নেতা শেখ মুজিব কে বঙ্গবন্ধু উপাধি তে ভূষিত করেন।
এরপর বাঙালির এগিয়ে যাবার পালা। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে।সংখ্যা গরিষ্ঠের নেতা বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা না দিয়ে তালবাহানা শুরু করে প্রতিমা শাষকগোষ্ঠী।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৪
১৯৭১সালের মার্চ মাস অনেক ঘটনা ঘটেছে। বাঙালির জীবনে একদিকে বেদনা বিধূর অন্যদিকে আনন্দ ও অর্জনের সমারোহ। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ।ঢাকার রেসকোর্সে ময়দানে জনাকীর্ণ এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেদিনের বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য একটি লিখিত বক্তব্য ছিল। বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে যাবার আগে চিন্তা মগ্ন ছিলেন , উত্তেজিত ছিলেন।এটি দেখে বেগম মুজিব বললেন, তোমার মন যা চায় তুমি তাই বক্তৃতা করবে। সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু তাই করলেন।যে বক্তৃতা করলেন সেটা স্মরনীয় হয়ে রইলো। বিশ্বের সেরা বক্তৃতার জায়গা করে নিল।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৫
১৯৭১সালের ২৫ মার্চ আমরা বাঙালিরা এটিকে কালো রাত বলি।পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নিরিহ বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল।ঢাকা শহরে হাজার হাজার মানুষ শহীদ হয়েছিল।সেই রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে নিজ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।পশ্চিমা সরকার বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে বন্দি করে রাখলেন।
এদিকে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৬
২৫ তারিখ ঢাকায় হাজার হাজার নিরিহ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। ময়মনসিংহের অনেক জায়গায় বাঙালিদের সাথে বিহারী দের সাথে বন্দুক যুদ্ধ হলো। বাঙালি ও বিহারী অনেক মানুষ মারা গেলো। লাশগুলো ট্রাকে করে নিয়ে কেওয়াটখালী শশ্মাণঘাটে ফেলে রাখা হলো। চারদিকে আতংক। জেলা আওয়ামীলীগের নেতারা সহ রেলওয়ে নেতারা ব্যস্ত।শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধের প্রস্তুতি।দলে দলে তরুণ ছেলেদের হালুয়াঘাট গাড় পাহাড়ের পাদদেশে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা কুদ্রত উল্লাহ মন্ডলসহ আওয়ামী লীগের নেতারা ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করছেন। আমার আব্বা আব্দুর রশীদ পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে শ্রমিক লীগের নেতা ছিলেন।তার খাওয়া দাওয়া নিয়ম মাফিক ছিল না। তরুণদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। আমরা ছোটরাও ব্যস্ত।সকাল বিকাল আমাদের পাড়ায় মিছিল বের করি। তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা,মেঘনা যমুনা। জেগেছে জেগেছে বীর বাঙালী জেগেছে।ঢাকা না পিন্ডি,ঢাকা ঢাকা।বীর বাঙালী অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করে। তোমার নেতা আমার নেতা,শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৭
মার্চ – এপ্রিল মাস ছিল উত্তাল, ঢাকার বাইরে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিরা তখনো ঢাকার বাইরে জেলাগুলিতে যেতে পারেনি। আমাদের পাড়ায় বড় ভাইয়েরা একদিন ষ্টেশন রোড গীর্জার মাঠ থেকে গাছ কেটে রাস্তায় নিয়ে ফেলছে।শোনা যাচ্ছে আজই পাক বাহিনীরা ময়মনসিংহ আসবে। তাদের ঠেকাতে হবে।আমরা ছোটরাও একজোট হলাম।তার যা আছে তাই নিয়ে আমরাও বীরদর্পে ঝাপিয়ে পড়লাম।দা,বটি,চাকু নিয়ে আমরা কলাগাছ কেটে জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে কলাগাছ রাস্তায় নিয়ে ফেললাম। পরদিন খবর পেলাম বাঙালি ইপিআরের একটি দল ট্রেনে যুদ্ধে যাচ্ছে।আমরা দৌড়ালাম ষ্টেশনের দিকে।গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়ানো।ট্রেন ভর্তি ইপিআর সৈনিক। তাদের অনেক আত্নীয় এসেছে।সবাই চোখের জল ফেলছে।তখনো ট্রেনের গার্ড সাহেব সবুজ পতাকা ড্রাইভারকে দেখান নি।এমন সময় একজন সৈনিক আমাকে ডাকলো।আমি কাছে যেতেই একটি বোতল আমার হাতে দিয়ে বললো,খোকা আমায় এক বোতল পানি এনে দাও।অমনি আমি বোতল নিয়ে দৌড়। চাপ কল থেকে পানি ভরে বোতল নিয়ে দৌড়ালাম।বোতলটি সৈনিক চাচার হাতে দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। সৈনিক চাচার আমাকে আদর করলেন। আমার চোখে জল এসে গেলো।আমি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছি।ট্রেন চলছে, আমার চোখের জল অবিরত পড়ছে।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৮
ময়মনসিংহে আমাদের বেশি দিন থাকা হয়নি।আব্বা মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যায়।আমরা খুবই চিন্তায় পড়ে যাই।এক সময় ময়মনসিংহের সাথে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।আব্বা সিদ্ধান্ত নেন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিবেন ।তাই হলো।পরিচিত দু’টি রিক্সা এনে একদিন সকালে আমরা রওনা হলাম।প্রথমে নান্দিনা ফুপুর বাড়ি তারপর দাদা বাড়ি সরিষাবাড়ী।পথে অনেক বাধা ছিল ।ফুফাতো ভাই সুজার ভাই সবটাই সামলে নিয়েছেন। জামালপুর মহকুমার নান্দিনায় ফুপুর বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। পরদিন রিক্সা যোগে সরিষাবাড়ী যাত্রা। জামালপুর শহরের উপর দিয়ে আমাদের যেতে হবে।শহরে ঢুকতেই থমথমে অবস্থা।জানা গেলো একটু আগে পাক বাহিনীরা তান্ডব চালিয়েছে। গুলিতে অনেক বাঙালি শহীদ হয়েছে।আমরা যখন দয়াময়ীর মোড়ে তখন লক্ষ করলাম মিষ্টির দোকানের দুইটি বড় কড়াই রাস্তায় উল্টে পড়ে আছে। অনেক গুলি রসগোল্লা রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।তিন চারটি কুকুর মিষ্টির রস চেটে চেটে খাচ্ছে।আর একটু সামনে এগিয়ে দেখি একটি রিক্সার উপর রিক্সাওয়ালা গুলি খেয়ে ঝুলে পড়ে আছে।রক্তে পিচ ঢালা পথ ভেসে গেছে।আমরা যতই এগুচ্ছি ততই ভয়ে ভীত হচ্ছি।দিকপাইত গিয়ে সরিষাবাড়ী রোডে যাওয়ার পর ভয় কিছুটা কেটে গেলো।আমরা বিকালে বাড়ি পৌঁছালাম। আমার আম্মাকে ধরে কান্না শুরু হলো।
পাকবাহিনীর সৈনিকরা থানায় থানায় আসা শুরু করেছে।আমাদের থানায় এসে ওরা আলহাজ্ব জুট মিলে অবস্থান নিল। মিলটি সরিষাবাড়ী রেল ষ্টেশন এর পিছনে। এলাকার বাঙ্গালীদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়লো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-৯
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কৃষক, শ্রমিক,ছাত্র- যুবা আবার বৃদ্ধ বণিতা সকলে পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর বলেছিলেন,”যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর।” আমাদের এলাকায় প্রায় প্রতি রাতেই মুক্তিতে যোগ দেয়ার জন্য যুবকরা ভারতের সীমান্তে চলে যাচ্ছে।এক রাতে আমাদের বাড়ি থেকেও বেশ ক’দিন মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলো।ইমান আলী কাকা, সেকান্দর কাকা, বারেক ফুপাসহ আরো অনেকে। এদিকে এলাকায় এলাকায় আলবদর বাহিনী,আল সামস বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। আমাদের এলাকায় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় গফুর মাস্টারকে। একটা বিভিষিকাময় অবস্থা চারদিক।
একদিন আমি আমার চাচাতো ভাইদের সাথে নদীতে বরশি দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছি।একটা বিভৎস লাশ ভাসতে ভাসতে নদীর ঘাটে আসলো।প্রথমে আমার চোখে পড়ে।ভয়ে আমি কথা বলতে পারছিলাম না।সবাই দেখার পর আমরা দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম। লাশটা ফুলে উঠেছিল। চেহারা চেনা যাচ্ছিল না।বেশ ক’দিন যাবৎ সেই লাশের চেহারা আমার চোখে ভেসে উঠতো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১০
একবার মুক্তিবাহিনী আলহাজ্ব জুট মিলে পাক বাহিনীকে আক্রমন করলো।যমুনার শাখা ঝিনাই নদীর অপর পাড় থেকে গুলি করছিল। গুলি আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে যাচ্ছিল।আমাকে আর আমার ছোট ভাই স্বপনকে কোলে নিয়ে ফারুক কাকা ঘরের পিড়ার পাশে(তখনো ঘরের ভিটি পাকা হয়নি)শুয়ে পড়লেন।কাকা আমাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।সারা রাত গুলি পাল্টা গুলি চলছিল।ভোর বেলায় উভয়দল গুলি করা বন্ধ করে দিল।সে রাতে খুবই ভয় পেয়েছিলাম।
আরেকদিন দিনের বেলায় দক্ষিণ পাড়া থেকে মুক্তি বাহিনী আক্রমন করলো। প্রচন্ড বেগে গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছিল গেরিলা মুক্তি বাহিনী। হঠাৎ আমার চেয়ে দুই তিন বছর বেশী বয়সী একটি ছেলে গুলি খেয়ে দৌড়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো।ওর পেটে গুলি লেগেছে। ভূরিটা বের হয়ে এসেছে।আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম।আমার চিৎকার শুনে দাদা বাহির বাড়ি এলেন।ছেলেটাকে দেখে কিছূটা অবাক হলেন।তারপর দাদা ছেলেটাকে নিয়ে সরিষাবাড়ী থানার হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।ফারুক কাকা আমাদের নিয়ে কোনা বাড়ি গেলেন। সেখানে আমাদের উত্তর পাড়ার অনেকেই ছিল।তারাও বড় গৃহস্ত। সেদিন দুপুরে আমাদের গণ খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন।সিম্পল খাবার।চাল কুমড়ার ঝোল।অমৃত লেগেছিল।যে বাড়িতে গিয়েছিলাম উনারা আমাদের আত্মীয় লাগে। সম্পর্কে আমার নানা।আমার আমরা উদ্ভ্রান্তের মতো আমাদের দু ভাইকে খুঁজছিলেন। আমাদের পেয়ে যেনো জীবন পেলেন।ফারুক কাকাকে গালিগালাজ করছিলেন।কেন না জানিয়ে আমাদের নিয়ে চলে এসেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১১
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট থেকে আমার দাদা জানতে পারলেন পাক সরকার এলান জারি করেছে যেসব ছেলেদের বয়স ১১ তাদের তালিকা করা হবে।কেন না যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে এই বয়সের বাঙালি ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যাবে।আমার দাদা ঐদিন রাতে আমাদের কে আমার নানার বাড়ি চাপারকোনায় পাঠিয়ে দিলেন।ভোর বেলায় একটি গরুর গাড়ি উঠানে এসে হাজির।আম্মা আমাকে আর আমার ছোট ভাই স্বপনকে কোলে নিয়ে গরুর গাড়িতে উঠলেন। তখনকার দিনে গ্রামে যাত্রীবাহন ছিল গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি।ঘোড়ার গাড়িকে টমটম বলা হতো।টমটমে উঠতে আমার খুব ভালো লাগতো।কাপড় চোপড়,পোটলা পাটলি উঠলো।দাদা মূলত আমাকে সেফ করার জন্য নানার বাড়ি চাপারকোনায় পাঠাচ্ছেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর কিছুই নেই। নানাদের গৃহস্ত অনেক বড়।নানারা চার ভাই। অনেক সম্পত্তি।
আমরা গ্রামের মানুষ জেগে উঠার আগেই চাপারকোনা গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।গরুর গাড়ি শব্দ করে চললো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১২
নানা বাড়ীর লোকজন আমাদের পেয়ে অনেক খুশি। প্রতিদিন দাওয়াত থাকে।আজ এ নানার ঘরে তো অন্যদিন আরেক নানার ঘরে। সম্পর্কে তারা মামা ও মামাতো ভাই বোন তারাও অনেক ভালো। মামাতো ভাই বোনদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।প্রতি সপ্তাহে চাপারকোনা হাই স্কুলে মুক্তি ক্যাম্পে খাবার দিতে হয়।নানারা তাদের কর্তব্য বলে এটাকে মনে করে।আমি বায়না ধরলাম মুক্তি ক্যাম্পে যাব। শেষ পর্যন্ত আম্মা রাজি হলেন।আমি মামা,মামাতো ভাইদের সাথে চললাম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।আমি চাপারকোনা হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাব।একটু সেজেগুজে না গেলে হয়!আমি আমার মুকুল ফৌজের সাদা ড্রেসটা পড়ে নিলাম। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে অবাক না হয়ে পাড়লাম না।শত শত মুক্তিযোদ্ধা।রাতের বেলায় অপারেশন করার জন্য গ্রুপে গ্রুপে বের হয়ে যায়।মামারা একটি গরু জবাই করে রান্না করে এনেছে।চট বিছানো হলো বারান্দায়। মুক্তিযোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে বসলো।বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধারা খাবার বেড়ে দিচ্ছিল।মামা, মামাতো ভাইয়েরা সহযোগিতা করেছিল।আমিও লবন ও পানি এগিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার বেশভোসা আলাদা দেখে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আদর করলো।কেউ কেউ বললো ভবিষ্যৎ মুক্তিযোদ্ধা।শুনে আমার খুব ভালো লাগছিল।খাওয়া দুইটি ব্যাচে হয়েছে।সবার খাওয়া শেষে কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা আমার সাথে কথা বলছিল।আমি কোথা থেকে এসেছি,কাদের আত্মীয় ইত্যাদি। আমার মামাতো ভাই লেবু ভাই।তার কথা বলাতে ওরা আমার পরিচয় পেয়ে গেলো।কথার ফাঁকে আমি ওদের বললাম তোমরা যে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ কর সেগুলো আমাকে দেখাবে? ওরা সাথে সাথে রাজি হলো। আমাকে ওদের রুমে নিয়ে গেল। সাথে আমার দুইজন মামাতো ভাই হেলাল ও বেলাল ছিল।অস্ত্রগুলির নাম জানতাম না। শুধু দেখলাম। অভিভূত হয়ে গেলাম।আরেকটু বড় হলে আমিও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারতাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,”যার যা আছে ,তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।”
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১৩
অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে বিমান থেকে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে বোমা ফেলা শুরু হলো। আমাদের সরিষাবাড়ী আলহাজ্ব জুট মিল আর্মি ক্যাম্পে বোমা ফেলার দৃশ্য নানা বাড়ি থেকে দেখে উপভোগ করছিলাম।আর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে খবর পাচ্ছিলাম পাক বাহিনীর পরাজয়ের কথা।১৬ ডিসেম্বরের আগেই দাদা বাড়ি চলে এলাম।সেকান্দর কাকা যেদিন বাড়ি আসলেন সেদিন উঠানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাক করে ফায়ার করা শুরু করলেন।জানান দিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেকান এসে গেছে।আমরা ছোটরা গুলির খোসাগুলো কুড়িয়ে নিলাম।চান কাকা গুলির খোসাতে ফু দিয়ে বাশি বাজাতে শুরু করলেন।আমি ওদের মতো বাঁশি বাজালাম।আর জয় বাংলা শ্লোগান দিলাম।আমরা যখন ময়মনসিংহ থেকে চলে এসেছিলাম তখন রেডিওটা আব্বার জন্য রেখে টেনজিষ্টরটা সাথে নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টার মজিবর স্যার প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিবিসি চালাতেন।সবাই উঠানে গোল হয়ে বসে খবর শুনতো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১৪
এদিকে সরিষাবাড়ী রেল ষ্টেশনে গিয়ে মাঝে মাঝে আব্বার খবর নিতাম।আব্বা কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো আত্মগোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতো।বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন।আমরা সবসময় চিন্তায় থাকতাম।আব্বা বাড়িতে আসতে চাইতো না।তার সাংগঠনিক এলাকা ছিল ময়মনসিংহ রেলওয়ে।তাই তো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ময়মনসিংহ রেলওয়েতে রেডক্রসের একমাত্র সদস্য করেছিলেন আমার আব্বাকে। আমাদের মনে আছে কম্বল বিতরণের সময় আমি একটা কম্বল বেশী চেয়েছিলাম।আব্বা এমনভাবে আমাকে কথা শুনালেন মনে হলো আমি তার ছেলে নই। কম্বল বিতরণ করে আব্বার খুব সুনাম হয়েছিল।
সবার মুখে শুনা যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। বাঙালিরা অধির আগ্রহে রয়েছে।ধীরে ধীরে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ আসলো।পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরছেন।১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। তেজগাঁও বিমান বন্দরে তিনি নামলেন।যারা ঢাকায় যেতে পারেনি তারা বাংলাদেশ রেডিও তে ধারা ভাষ্য শুনছিল। আমরাও আমাদের সেই টেনজিষ্টর চালিয়ে আমাদের উঠানে বসে শুনছিলাম।মজিবর স্যার ঠিক সময়ে এসে আম্মার কাছে থেকে টেনজিষ্টর নিয়ে চালিয়েছিলেন।আমরা সেদিন অনেকেই উত্তেজিত। বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরে পাচ্ছি।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা -১৫
সরিষাবাড়ী থেকে সকালে একটি ট্রেন ময়মনসিংহে যায়। পৌঁছে দুপুর ২টায়। একদিন খবর পেলাম বেগম’ বু তার মেয়েদের নিয়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছে।বেগম ‘বুর বাসা কাঁচিঝুলি, আনন্দ মোহন কলেজের পাশে।বেগম বু’র হাজবেন্ড রফিক দুলাভাই। কন্ট্রাকটার। ভালো ব্যবসায়ী।আমি আম্মার কাছে জেদ ধরলাম।আম্মা বাধ্য হয়ে রাজি হলো।আমি ট্রেন থেকে নেমে সোজা আব্বার অফিসে চলে গেলাম।আব্বার সহকর্মী বললো,তোমার আব্বা তো আগের বাসায় নেই।বাসা লুট হবার পর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতো।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেল লাইনের ওপার নাটকঘর লেনের প্রথম বাসায় দোতলায় থাকেন।আমি চলে গেলাম।দরজায় নক করতেই একটি ছেলে দরজা খুলে জিগ্গেস করলো,কার কাছে যাবা? আমি পরিচয় দিলাম আব্দুর রশীদ আমার পিতা।সাথে সাথে আমাকে দুতলায় নিয়ে গেলো।আব্বা আমাকে দেখে তো অবাক। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধূতে বললো।ছেলেটাকে খাবার দিতে বললো। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি কৈ মাছের তরকারি।কৈ মাছ বিশাল। মোহনগঞ্জ হাওড়ের হবে। খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। গোগ্রাসে খেয়ে আব্বার রুমে বিছানায় উঠে বসলাম।আব্বা অনেক কিছু আমার কাছ থেকে জানালো।আব্বা বললো তোদের সবাইকে ক’দিন পর ময়মনসিংহে নিয়ে আসবো।বাসা লুট হয়ে গেছে। কিছু খাট পালং কিনতে হবে।
আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।মনটা ভরে গেলো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১৬
পরদিন আব্বা আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। অবশ্য এক সপ্তাহ পর আব্বা আমাদেরকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসলেন।কলোনীর অন্যরা আমাদের আগেই চলে এসেছে। আমার বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হলো।যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। চারদিকে হাহাকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন আর বক্তব্য দিচ্ছেন।বলছেন, সকলকে কাজ করার জন্য।কৃষক,শ্রমিক,যুবকদের কাজ করে উৎপাদন বাড়াতে বললেন। যুবকদের বললেন,যুবক ভাইয়েরা এবার ফুলপ্যান্ট রেখে হাফপ্যান্ট পড়। কৃষকদের, শ্রমিকদের সাথে কাজ কর। আমাদের দিন এমন থাকবে না।
বঙ্গবন্ধুকে দেখার ইচ্ছে আমার প্রবল থেকে প্রবল হতে থাকলো।আব্বা তো খুব ব্যস্ত।বাসায় যখন আব্বার বন্ধুরা এসে গল্প করে ,আমি চুপ করে পাশে বসে শুনি। ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু আসবেন এটা নিশ্চিত।মুকুল ফৌজে যাই।রতনদা আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়। স্বাধীনতা,বিজয় দিবসে সার্কিট হাউস মাঠে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করি। একবার যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ময়মনসিংহ আসলেন।রেল শ্রমিক লীগ আলোচনা সভার আয়োজন করলেন।রেল ষ্টেশন এর পিছনে মন্চ করা হলো। আমাদের ক’জন বন্ধুকে ফুলের মালা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলা হলো। আমার মনে পড়ে আমি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী,মন্ত্রী মহোদয়কে মালা পড়িয়ে দিয়েছিলাম।এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু আসলেন ময়মনসিংহে।

বঙ্গবন্ধুকে দেখা-১৭
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ময়মনসিংহে আসবেন সাজসাজ রব পড়ে গেলো।ঘরে ঘরে আওয়াজ বঙ্গবন্ধু আসবে।আমরা পাড়ার ছেলেরা একজোট হয়েছি। স্কুলের বন্ধুরা ও পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে আমরা সার্কিট হাউজের মাঠে উপস্থিত হলাম। বঙ্গবন্ধু আসবেন তিন টায়।দুইটার মধ্যে সার্কিট হাউস মাঠে ভরপুর। ময়মনসিংহের সব থানা থেকে ছুটে এসেছে মানুষ।সদর থানা, মুক্তাগাছা, গৌরীপুর, গফরগাঁও, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, পূর্বধলা,নান্দাইল,হালুয়াঘাট, ফুলবাড়িয়া,ভালুকা। বঙ্গবন্ধু যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন মৃত্যুর মুখোমুখি তখন বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর জন্য পরম করুণাময় এর কাছে দোয়া করেছে।সেই বাঙালিরা এসেছে সেই নেতাকে এক নজর দেখতে।আমরা ছোট ছিলাম বলে মহিলাদের পিছনে জায়গা করে বসে পড়লাম।ষ্টেজ খুবই কাছে। অমি,দুলাল,আশফাক, সিদ্দিক, নজরুল, সেলিম,আতিকসহ অনেকে। হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেলাম।সবাই শ্লোগান দিতে থাকলো-জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। জেগেছে জেগেছে বীর বাঙালী জেগেছে। তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব,শেখ মুজিব। হেলিকপ্টার থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু নৌকার আদলে তৈরি করা মন্চে উঠলেন।
“কখন আসবে কবি,কখন আসবে কবি/শত বছরের সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দ্রীপ্ত পায়ে হেঁটে/
অতঃপর কবি এসে জনতার মন্চে দাঁড়ালেন।/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,হৃদয়ে লাগিল দোলা/জন সমুদ্রে লাগিল জোয়ার/সকল দোয়ার খোলা/কে রুধে তাহার বজ্র কন্ঠ বাণী”।
বঙ্গবন্ধু ষ্টেজে সিড়ি বেয়ে উঠলেন।কি বিশাল মানুষ, আমরা অভিভূত।বক্তব্য শুরু করলেন।কি কন্ঠ? এমন কন্ঠ পৃথিবী শুনেনি।কি দরাজ কন্ঠ।কি অদ্ভূত বাচন ভঙ্গি।কি সম্মোহিনী শক্তি।
বঙ্গবন্ধু বললেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা,আপনারা আমার ছালাম গ্রহন করুন।ওরা দেশকে ধ্বাংস করে দিয়েছে।আমি আপনাদের তিন বছর কিছুই দিতে পারবো না।আপনারা রাজি? সকলে দুই হাত তুলে স্মৃতি জানালেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কথা বললেন।
আমি সেই স্কুল বয়সে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেয়েছিলাম।আমি ধন্য,আমি ধন্য।জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু।