উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বাড়াতে দুই বছর আগে নেওয়া নতুন সংস্কার কাজে আসেনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছিল অর্থ ছাড় প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন করায় এ সংক্রান্ত জটিলতা কেটে যাবে।
কেননা এখন থেকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা প্রকল্প পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কার্যকর হয়নি। শুরু থেকেই গতি বাড়ানোর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।
ফলে চলতি অর্থবছরের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় খরচ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, যা মোট সংশোধনী এডিপি বরাদ্দের ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুন শেষে বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় না হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন এমনিই স্বাভাবিক সময়ে মূল এডিপিতে যা বরাদ্দ দেওয়া হয় সেটি মাঝপথে কাটছাঁট করে কমিয়ে আনা হয়।
এ কমানো বরাদ্দও শেষ পর্যন্ত বড় একটি অংশ অব্যয়িত থাকে। এবার চলমান করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ খরচ করতে না পারা অর্থের পরিমাণ বাড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, অর্থবছরের বাকি আছে আর এক মাস। শেষ পর্যন্ত গত অর্থবছরের চেয়ে সামান্য বেশি অর্থ ব্যয় হতে পারে। অর্থাৎ এডিপি বাস্তবায়নের হার ৮১-৮২ শতাংশ হতে পারে। যদিও এখনই সংখ্যা দিয়ে বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে বড় একটি অংশ ব্যয় হয়তো হবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে যে সংস্কার আনা হয়েছিল সেটি খুব একটা কাজে লাগেনি। কেননা পরিকল্পনা কমিশন হতে অর্থছাড়ের কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো হয়তো অধিদপ্তরকে টাকা দেয়।
কিন্তু তারা আর পিডিদের কাছে দেয় না। কোথায় যেন একটা বাধা আছে। ফলে সুন্দর উদ্দেশ্য থাকলেও সেটি কাজ হয়নি। তবে বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করে দেখব।
সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পের গতিহীনতার যে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অর্থছাড়ের ধীর গতি ছিল অন্যতম।
এ সংকট কাটিয়ে অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রকল্পে পুরোদমে কাজ চালুর লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশেষ সংস্কার আনা হয়। জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন সংস্কার হিসাবে বলেন- উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থছাড়ের প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে অনুমোদিত সরকারি প্রকল্পের চতুর্থ কিস্তি পর্যন্ত অর্থ ব্যবহারের ক্ষমতা প্রকল্প পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে অর্থ ছাড়ের জন্য ইতঃপূর্বে যে এক থেকে দুই মাস সময়ের প্রয়োজন হতো তা বেঁচে যাবে। এ কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে।
একাধিক প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন সংস্কার অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। আগের মতোই অর্থ ছাড় থেকে দুই-তিন মাস সময় লেগে যায়।
তারা বলেন উদ্যোগ মহৎ হলেও কেউ কারও ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) মূল এডিপির বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে ৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয় ২ লাখ ৯ হাজার ৭২ কোটি টাকা। গত ১১ মাসে (জুলাই-মে পর্যন্ত) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পরেছে ১ লাখ ২২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে এক মাসে অর্থাৎ জুনের মধ্যে ব্যয় করতে হবে ৮৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এক্ষত্রে যদি পুরো অর্থবছরে ৮২ শতাংশও সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয় তাহলে খরচ হবে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অব্যয়িত থাকতে পারে ৩৭ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থাৎ ১১ মাসে ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বা ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক সলিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের মৌলিক সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে শুধু একটি সমস্যার সমাধান করলে তো হবে না। সাময়িক হয়তো লাভ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সেটি কোনো ফল দেয় না। এজন্য সংস্কার আনতে হবে গোড়া থেকেই। অর্থাৎ প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, ক্রয় কার্যক্রম দ্রুত করা এবং ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে হবে। ঠিকাদাররা অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করে না। এজন্য তাদের কোনো শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয় না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অর্থছাড় প্রক্রিয়া সহজ করা উদ্যোগটিও যদি কাজে লাগত তবুও কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের গতি বাড়ত।
গত কয়েক বছরের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল এডপির আকার ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সেখান থেকে কাটছাঁট করে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয় ২ লাখ ১ হাজার ১৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
অর্থবছর শেষে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় সংশোধিত এডিপির ৩৯ হাজার ৪৫৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। মাঝপথে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থবছর শেষে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৯ হাজার ৪৩৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
Array