অনলাইন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একবার বলেছিলেন, ‘নৈতিক পথের বাঁক অনেক লম্বা। তবে শেষ পর্যন্ত সেই পথ ন্যায়ের দিকেই যায়।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকারের লড়াইয়ে বিজয় আসবেই এবং তার বিশ্বাস একসময় সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
গত সপ্তাহে অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরের শরণার্থী শিবিরে ইসরাইল তাদের সবশেষ হামলা চালিয়েছে। ওই হামলায় অন্তত ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এছাড়া জেনিনের পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং প্রায় ৮০ শতাংশ ঘড়বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ অবস্থায় ফিলিস্তিনিরা যে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, তাদের সন্দেহ হতে পারে যে, নৈতিকতার পথ তাদের জন্যও কি ন্যায়ের পথে বাঁক নেবে?
সম্প্রতি অধিকৃত জেনিনে হামলা চলমান শতাব্দীর জায়নবাদী (ইহুদিদের একটি ভাবাদর্শ) ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিচ্ছবি। যে আগ্রাসনের কারণে আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, আটক হয়েছেন এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
চলতি বছর ইসরাইলি বাহিনী প্রায় ৩০টি শিশুসহ ১৭০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে দখলদার এ বাহিনী ফিলিস্তিনের গ্রাম ও শহরগুলোতে প্রায় ৫৭০টি হামলা চালিয়েছে, যার অর্থ প্রতিদিন গড়ে তিনটি হামলা চালানো হয়েছে।
ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাজুড়ে অনেক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় যে, দুটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের সংগ্রামের ভিত্তি শক্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের কূটনীতি ও বৈশ্বিক নানা কার্যক্রমে বুঝা যাচ্ছে যে, কয়েক দশক ধরে যে জায়নবাদী ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতা প্রায় বিনা বাধায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে, আজকের পৃথিবীতে তাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ ক্রমেই বাড়ছে।
পরিবর্তন ও আশার একটি প্রতীকী চিহ্ন দেখা গেছে চলতি বছরের মে মাসে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ) প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি নাকবার (বিপর্যয়) ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে।
জায়নবাদের বহুল প্রত্যাশিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্য জায়গা করে দিতে ১৯৪৭-৪৮ সালে ইসরাইল কর্তৃক জাতিগত নিধন ও ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে দেশ থেকে নির্বাসিত করার ঘটনাটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। নাকবা শব্দের অর্থ বিপর্যয়।
১৯৪৭ সালে ইউএনজিএ যখন ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি দুই ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাস করে, তখন সেখানে ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নের’ বিষয়টি এসেছিল সামান্যই, অনেকটা দায়সারাভাবে। তবে চলতি বছরের নাকবা দিবসে দায়সারা নয় বরং প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে।
অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, ৭৫ বছর আগে জাতিসংঘ গৃহীত যে সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের জাতীয় বিপর্যয়ে সূচনা করেছিল, এ বছর নাকবা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ইউএনজিএ পরোক্ষভাবে তার দায় স্বীকার করছে।
এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিতে নাকবা বা বিপর্যয় এখন দৈনন্দিন বাস্তবতা। গত সপ্তাহে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জেনিনের ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির থেকে হাজার হাজার শরণার্থীকে উচ্ছেদ করার ঘটনায় ফিলিস্তিনিরা সেই বাস্তবতা আবারও প্রত্যক্ষ করেছে।
জায়নবাদীরা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৭ সালে দেশভাগ রেজ্যুলুশনের জন্য ব্যাপক দেরদরবার করেছিল এবং তারা সফল হয়েছিল। ৭৫ বছর পর নাকবা দিবস পালন প্রতিহত করার জন্য তারা আবারও ব্যাপক দেনদরবার করেছে। তবে এবার তারা পরাজিত হয়েছে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে।
নাকবা দিবসে মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিরা ইসরাইলের দখলদারি ও ঔপনিবেশিক নীতির নিন্দা প্রকাশ করেন এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য নিরাপদ ও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানান। যে দাবির মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয় ফিলিস্তিনি সংগ্রামের সমর্থনে অশ্রুতপূর্ব আন্তর্জাতিক সংহতি বিশেষ করে আইন, কূটনীতি, রাজনীতি, গণমাধ্যম ও শিক্ষাক্ষেত্রে।
ইসরাইল ও তার মিত্ররা বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনের সমর্থনকে প্রতিহত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি, ইসরাইলের নীতির সমালোচকদেরও কণ্ঠরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা-যে নীতিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং বেৎসেলেমের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো জাতিবিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
চলমান সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বর্জন, বিয়োগ ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বৈধ অহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন করার অধিকার।
ফলে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। কয়েক দশক আগে যে বৈশ্বিক বর্জন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী জাতিবৈষম্য ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিল, বিডিএস আন্দোলন তারই প্রতিচ্ছবি।
জায়নবাদীরা এই তুলনা পছন্দ না করলেও একে থামাতে পারছে না। বহুদিন ধরেই প্রতিপক্ষের কণ্ঠরোধের জন্য জায়নবাদীদের প্রিয় কৌশল ছিল, কেউ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বললে বা ইসরাইলি নীতির সমালোচনা করলেই তাদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের ধুয়া তুলে তাদের থামিয়ে দেয়া। তবে এখন আর সেই কৌশলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক এবং জাতীয় নির্বাচনে তরুণ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের বিজয় ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে আরও বেগবান করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেবে কংগ্রেস সদস্য রাশিদা তালিব এবং ইলহান ওমরের কথা উল্লেখযোগ্য, যারা ইসরাইলের জাতিবৈষম্য ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রকাশ্য সমালোচনা করে থাকেন।
যদিও সংখ্যায় তারা অনেক কম, তবে সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে এবং তাদের প্রকাশ্য প্রতিবাদ ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের বিষয়ে মার্কিন জনসাধারণের মনোভাবের ধীর অথচ স্থির পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
অতীতে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ঢালাও সমর্থন থাকলেও বর্তমানে দুপক্ষের সমর্থন প্রায় সমান। গ্যালাপের এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটরা বর্তমানে ইসরাইলিদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল (৩৮ শতাংশ বনাম ৪৯ শতাংশ)। এই ধারা চলমান থাকবে, কারণ তরুণ মার্কিনিরা, যাদের মধ্যে ইহুদিরাও রয়েছেন, বর্তমানে এই দ্বন্দ্বে আরও নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করেন।
কূটনীতি, সুশীল সমাজের কার্যক্রম ও জনমতের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের ন্যায়বিচারের জন্য বিশ্বব্যাপী সমর্থনের এই চলমান পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকে তার বর্ণবাদী দখলদারি নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করার জন্য যথেষ্ট চাপ তৈরি করবে এবং প্রকৃত শান্তি আলোচনার সূচনা করবে, যেখানে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি উভয় জনগোষ্ঠীকেই সমান জাতীয় অধিকার ও নিরাপত্তা দেয়া হবে। তবে এই পরিণতিতে পৌঁছতে সময় লাগবে, যেমন লেগেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে বরাবরের মতো এবারও নৈতিকতার পথ ন্যায়ের দিকেই বাঁক নেবে।