obak
11th Aug 2023 2:05 pm | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক: চলতি বছর একের পর এক উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এপ্রিলে পাবনা জেলায় তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই মাসে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে হয় সাড়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ভেঙে দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত সময়ের সব রেকর্ড।
দেশের আবহাওয়ার দশা হয়েছে দুই রকমের। হয় প্রচণ্ড গরম পড়ছে আর না হলে এত বৃষ্টি হচ্ছে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে দাবদাহ, অন্যদিকে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিতে মানুষের জীবনযাত্রা দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের জলবায়ু পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে সে অবস্থাকে বলা হয় মৃদু দাবদাহ। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে বলা হয় মাঝারি এবং ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করলে সেটিকে বলা হয় তীব্র দাবদাহ।
সে হিসেবে বিগত কয়েকমাসে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তীব্র দাবদাহ। তবে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নগর জীবনে গরমের প্রভাব কমলেও বেড়েছে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ। অনেকেই বলছেন এই বৃষ্টির মধ্য দিয়ে শেষ হবে দাবদাহের দিনকাল। তবে দেশের আবহাওয়া অধিদফতর দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য।
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, একদিনের মধ্যে বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসবে। পরে আবার কয়েক দফা বৃষ্টি হবে। তবে চলতি মাসের শেষের দিকে এসে আবার গরম পড়তে শুরু করবে। তবে এই তাপমাত্রা দাবদাহে রূপ নেবে কি না তা এখনই নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে দাবদাহের তাপমাত্রা মানুষের কাছে ভিন্ন রকম ঠেকেছে। যেখানে আগে গরমে মানুষ দরদর করে ঘামতো, সেখানে এ মৌসুমে গরমে মানুষের মনে হয়েছে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে এবং মাথার তালু পর্যন্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। অনেকের এমনও অভিজ্ঞতা ছিল, প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও একফোঁটা ঘামছেন না; কিন্তু শরীরে তাপের প্রচণ্ড তীব্রতা অনুভব হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, মূলত এবারের দাবদাহে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় মানুষ ঘামছে কম, কিন্তু গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। চামড়ায় আর্দ্রতা কমে আসায় তীব্র গরমের মধ্যেও মানুষের ঠোঁট ফাটছে এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে।
এ ধরণের আবহাওয়া দেখা যায় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বাংলাদেশে কেন এমন আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আইনুনু নিশাত বলেন, গরমের সময় মূলত তাপমাত্রা বেশি থাকলেও মাঝে মাঝে যে দখিনা বাতাস পাওয়া যায়, তাই শরীর জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এবারের গরমে দক্ষিণ দিক থেকে শীতল বাতাস না এসে বাতাস এসেছে পশ্চিম থেকে। পশ্চিমের হল্কা বাতাসে প্রশান্তির বদলে মানুষের মনে হয়েছে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমের এই হল্কা বাতাসের উৎস নিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, মূলত এ বাতাস আসছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানকার বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুবই কম। তাই সেই গরমে শরীর পুড়ে যাচ্ছে বলে অনুভূত হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমা বাতাস পাকিস্তান হয়ে ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মায়ানমারের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এতে করে দেশে দখিনা বাতাসের বদলে আগুনের ফুলকির মতো পশ্চিমা গরম বাতাস ঢুকছে।
নিশাত বলেন, দিনের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যেখানে কক্ষ তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখান অনুভূত তাপমাত্রার পরিমাণ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে, অনুভূত তাপমাত্রার পরিমাণ কতটা বেড়ে যায়। একে গরম বাতাস, অন্যদিকে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকায় মানুষের অস্থিরতার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ গোলার্ধে না, জলবায়ু পরিস্থিতি দিনকে দিন উত্তর গোলার্ধেও শোচনীয় রূপ ধারণ করছে। প্রচণ্ড দাবদাহ, দাবানল এবং বন্যার মতো দুর্যোগে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববাসী।
ওয়ার্ল্ড মেট্রোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) এর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে হয় প্রচণ্ড গরম পড়ছে, না হলে ভয়াবহ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে চলতি বছরের জুলাই ছিল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। অন্যদিকে চীনের সরকারি তথ্য বলছে, জুলাইতে এবং আগস্টের শুরুতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা ভেঙে দিয়েছে বিগত বছরের সব রেকর্ড। এদিকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে শীতকাল হওয়ার পরেও সেখানে বইছে দাবদাহের হাওয়া।
এসবের বাইরে এ বছর জুনে কানাডায় ইতিহাসের ভয়াবহ দাবানল হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো। কানাডার কুইবেক প্রদেশের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত। কানাডায় এক মাসে মোট ১৪০ জায়গায় দাবানল হয়েছে, যার উত্তাপ ছুঁয়েছে আমেরিকাকে পর্যন্ত। কানাডার দাবানলে ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল নিউইয়র্কের আকাশ অবধি।
শুধু কানাডা না, ডব্লিউএমও বলছে, ভূমধ্যসাগরীয় অনেক দেশ যেমন আলজেরিয়া, গ্রিস, ইতালি এবং স্পেনের মতো দেশেও ঘটেছে অপ্রত্যাশিত দাবানলের মতো ঘটনা। জুলাইতে কেবল গ্রিসের দাবানলে যে পরিমাণ গাছ পুড়েছে এবং যতটুকু কার্বন নিঃসরণ হয়েছে তা ভেঙে দিয়েছে বিগত ২১ বছরের কার্বন নিঃসরণের রেকর্ড- এমনটাই জানিয়েছে দেশটির সরকারি আবহাওয়া অধিদফতর।
দিনকে দিন জলবায়ু পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে জানতে চাইলে জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞানী আতিক রহমান সময় সংবাদকে বলেন, জলবায়ু এখন এমন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ছোটখাটো আর কোনো ঘটনা ঘটছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে খারাপ রূপ প্রত্যক্ষ করছেন সাধারণ মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রতিকার হাতে না থাকলেও প্রতিরোধের ব্যবস্থা এখন থেকেই করতে হবে।
এদিকে জলবায়ু বিপর্যয়ে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ডব্লিউএমও’র সেক্রেটারি জেনারেল পেটেরি তালাস বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের সবচেয়ে মারাত্মক ও প্রথম লক্ষণ হচ্ছে বর্তমানের তীব্র তাপমাত্রা। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব শুধু পরিবেশের ওপর না, মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, জ্বালানি এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ওপরে পড়বে। এখনো সময় আছে যত দ্রুত সম্ভব গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ এবং কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে।
বিশ্ব আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়েদার এট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, বিশ্ব বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিরুদ্ধ কার্যক্রম। বিশ্বের শিল্পন্নোত দেশগুলো সবকিছু জানার পরেও যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে তাতে করে দিনকে দিন জলবায়ু আরও সংকটময় পরিস্থিতি ধারণ করছে বলে জানায় সংস্থাটি।