obak
24th Apr 2023 1:58 am | অনলাইন সংস্করণ
আনলাইন ডেস্ক: জলবায়ু সংকটের কারণে ধরণী যখন ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে, তখন কোনো কিছুই আর নিরাপদ থাকছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বিস্তৃত লেক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন—কেউই সুরক্ষিত না। উষ্ণায়নের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রাকৃতিক সম্পদও ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।
সুন্দরবনকে বলা হয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ম্যানগ্রোভের বন। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। খাবার পানির সংকটে স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। সিএনএন, ডয়চে ভেলে ও এনডিটিভির খবরে এমন তথ্য মিলেছে।
মার্কিনভিত্তিক সিএনএনের প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে যে খরার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সল্ট লেক এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যে, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে সেটি অদৃশ্য হয়ে যাবে।
বর্তমানে যেভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী শতাব্দির শেষ দিকে ইউরোপের আলপস পর্বতামালার বরফ ৭০ শতাংশ গলে যেতে পারে। এদিকে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, আর চরম আবহাওয়ার কারণে সর্বশেষ আবাসস্থলটিও হারাতে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
এতে বিভিন্ন কমিউনিটিতে যেমন বিপর্যয় নেমে এসেছে, তেমনই কিছু কিছু গাছপালা ও বন্যাপ্রাণীও বিপন্ন হওয়ার পথে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) খবর বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় রেকর্ড তৈরি হয়েছে গেল আট বছরে। এ সময়ে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ও পুঞ্জিভূত তাপও বেড়েছে।
গেল বছরে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল প্রাক-শিল্প যুগের মাত্রার চেয়ে এক দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওপরে। প্রাক-শিল্পযুগ বলতে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালকে বোঝানো হয়েছে।
ডব্লিউএমও’র তথ্যানুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২২২ সাল পর্যন্ত বার্ষিক বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এই আটটি বছরকে সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে তাপমাত্রার যে এক দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, তা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কাও সময়ের সঙ্গে বাড়ছে।
পাশাপাশি উষ্ণায়ন-কেন্দ্রিক দূষণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে পৃথিবী এক অপরিবর্তনীয় সংকটের দিকে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ পৃথিবী এমন এক সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এছাড়া বেশ কিছু প্রাণি ও বাস্তুসংস্থান এমনভাবে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে যে তা আর কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না।
কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই যে এমন বিপর্যয়, তা কিন্তু না। এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণ রয়েছে। মানবসৃষ্ট সংকটগুলোও কিছুটা দায়ী। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতোটাই সর্বব্যাপী হচ্ছে যে, প্রাণি ও উদ্ভিত জগতের ওপর সেই চাপ অসহনীয় মাত্রায় চলে গেছে।
ধরণীকে যদি উষ্ণতার প্রভাব থেকে এক বিন্দু পরিমাণ রক্ষা করা সম্ভব হয়, তবে তা বৈচিত্র্যপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থানকে রক্ষা করার সুযোগকেও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু পৃথিবীকে কতটা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে, তা নির্ভর করছে, কতটা বিদ্যুৎ গতিতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনা আপাতত দেখা হচ্ছে না।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চার হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন। এই ম্যানগ্রোভ বনটিতে বেশ কিছু বিপন্ন প্রজাতির প্রাণিও বাস করছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারও রয়েছে। জলবায়ু সংকট প্রকট হয়ে ওঠার সঙ্গে এই বনাঞ্চলের ঝুঁকিও ক্রমে বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প কয়েক ফুট উপরে এই বনভূমি। আর প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় এসে আঘাত হানছে সুন্দরবনে।
সাধারণত বঙ্গোপসাগরে উৎপত্তি হওয়া ঘূর্ণিঝড় থেকে স্থলভূমিকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে ম্যানগ্রোভ বনটির সেই সক্ষমতাও কমে এসেছে। এতে করে বাংলাদেশ তার একটি রক্ষাকবচকে হারাতে বসেছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে অঞ্চলটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ২৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
কম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও আইলার কারণে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। তাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাটির ঘর থেকে শুরু করে ক্ষেতের ফসল ও গবাদিপশু ভেসে গেছে। এরপর ২০১৯ সালে ফণী ও বুলবুল আঘাত করে। পরের বছর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।
এসব ঝড়ে সাগরের লোনাপানি স্থলভূমিতে উঠে পুকুর ও গভীর নলকূপের সুপেয় পানিকে দূষিত করে দিয়ে যায়। খাবার পানি লবণাক্ত হয়ে গেলে তাতে হৃদরোগসহ ডায়েরিয়া ও পেটে ব্যথা হতে পারে। যা স্থানীয়দের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ওঠে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিও বেশি ঘ্টছে। আর লোনা পানিতে বনের গাছাপালা মরে যাচ্ছে। এতে বাঘ ও তার শিকারের আবাস সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাঘের শিকার হারিয়ে গেলে প্রাণিটির টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক শরিফ মুকুল সিএনএনকে বলেন, যদি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না আসে, তাহলে আমরা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল খোয়াতে যাচ্ছি।
এভাবে চলতে থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাসের জন্য উপযুক্ততা হারাবে সুন্দরবন। এমন পূর্বাভাস দেয়া একটি গবেষণার সহ-লেখক শরিফ মুকুল।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঘ রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেবল জলবায়ু পরিবর্তনই না, বেআইনি শিকারের হাত থেকেও বাঘকে রক্ষা করতে হচ্ছে। বাঘ গণনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হচ্ছে।
শরিফ মুকুল মনে করেন, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব থেকে সরে আসতে যদি দ্রুত গতিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে আমরা হয়ত সবকিছু হারাতে যাচ্ছি।
জার্মানভিত্তিক ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের চারপাশে বাস করা লোকজন তাদের স্বল্প-আয়ের একটি বড়ো অংশ পানি কিনতেই ব্যয় করছেন। সুপেয় পানির বিকল্প উপায়গুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে অর্থ খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে তাদের।
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবন এলাকায় ২০০৮ সাল থেকে দূষিত পানি খেয়ে এক হাজার ৯২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখ স্থানীয় মানুষ। এরপর থেকে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়া-তো দূরের কথা ক্রমে অবনতির দিকেই যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে জানিয়েছে, দূষিত পানির এই সংকট শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে নানারকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে পানি শূন্যতা, উচ্চ রক্তচাপ, প্রসবপূর্ব জটিলতা ও শিশু মৃত্যুহার বাড়িয়ে দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের তিনটি প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর বলে জানিয়েছেন ভারতীয় বন বিভাগের সাবেক ওয়াল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন ড. প্রদীপ ভিয়াস। এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এসব ঝড়ের তীব্রতা বেশি না হলেও বারবার হচ্ছে। এতে বনটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই বন বিশেষজ্ঞ বলেন, ঝড়ের কারণে মানুষের ক্ষেতের ফসল ও সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে। এক সময়ে তারা জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হচ্ছেন। ঘূণিঝড়ের কারণে জলোচ্ছ্বাসে সাগরের পানিতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে যায়। এতে আর যা-ই হোক না কেন, ফসল ঘরে তুলতে পারেন না কৃষকরা।
“এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের উপরিভাগও স্ফীত হয়ে উঠছে। এতে অনেক বেশি লবণ দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। মানুষ-তো দীর্ঘ সময় ধরে লোনা পানি সহ্য করতে পারে না। আর এ পানি খাওয়ারও অযোগ্য।”
ড. প্রদীপ ভিয়াস বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় বাবা-মা ও পরিবারকে সহায়তা করতে গিয়ে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ছে বহু শিশু। এক সময় তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: সময় সংবাদ