obak
12th Jun 2022 6:27 am | অনলাইন সংস্করণ
আমার বাবা, মুক্তিযুদ্ধ ও আমি
-হামিদুল আলম সখা
আমার বাবা মরহুম আব্দুর রশীদ পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের একজন কর্মচারী ছিলেন।তার কর্মস্থল ছিল ময়মনসিংহ। পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে শ্রমিক লীগ , ময়মনসিংহের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ময়মনসিংহ রেলওয়ে ক্লাবের নির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন।প্রতি বৎসর নাটক হতো। আমার বাবা নায়কের অভিনয় করতেন।গীতা,নতুন,সূচন্দা,কবরী নায়িকা হিসেবে ময়মনসিংহ রেলওয়ে সাইদুল হক মিলনায়তনের মঞ্চে অভিনয় করেছেন। অধিকাংশ নাটকে আমার বাবা নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন। আমার বাবা খুব সৌখিন ছিলেন। একবেলা যে পেন্ট সার্ট পড়ে তা অন্য বেলা পড়তেন না।বাইরে যাওয়ার আগে সবসময় পারফিউম ব্যবহার করতেন।পৌর সভার নির্বাচনে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান এর নির্বাচনে কাজ করতেন পাগলের মতো।১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কার জন্যও।শ্রমিক লীগের দায়িত্ব ছিল ময়মনসিংহ রেলওয়ে ভোটারদের।
২.
আমরা ছোটরা কলোনিতে সকাল বিকাল মিছিল করতাম।নৌকা মার্কার পক্ষে। শ্লোগান দিতাম জেগেছে জেগেছে, বীর বাঙালি জেগেছে।ঢাকা না পিন্ডি ঢাকা ঢাকা।শেখ মুজিবের নৌকা মার্কায় দিন। আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।জয় বাংলা। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিব এর নৌকা মার্কার জয় হলো। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জয় হলো।১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন নৌকা মার্কার জয়লাভ হলো।এরপর শুরু হলো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তালবাহানা। বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শুরু হলো ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় ঘোষণা করলেন ,” এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” পশ্চিম পাকিস্তানীরা ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরিহ বাঙালির উপর হামলা করে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করলো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।” ২৬ মাচ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার।তারবার্তা পাঠানো হলো ১৯ জেলায়। বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালিরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
এদিকে ময়মনসিংহে বাঙালি ছাত্র,শ্রমিক ,কৃষক, সকলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার বাবা ও রেলওয়ের অন্যান্য নেতারা রেলওয়ের যুবকদের হালুয়াঘাট গাড় পাহাড়ের পাদদেশে আওয়ামী লীগ নেতা কুদরৎ উল্লাহ মন্ডলের ক্যাম্পে পাঠানো হলো। আমাদেরকে রিক্সাযোগে সরিষাবাড়ী গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সহায়তার জন্য রাজাকার,আলবদর,আল শামস বাহিনী গঠিত হলো। একদিন সকালে ৭টার সময় আমাদের কলোনি আর্মীরা ঘেরাও করলো। আগেভাগে খবর পেয়ে আশফাকের বাবা দৌড়ে আমাদের বাসায় এসে আমার বাবাকে খবর দিল। রশীদ মিয়া জলদি ভাগো, আর্মি আ যায়েগা ।আমার বাবা বাসার পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সার্ভিস টয়লেটের ভিতর সারাদিন বসে ছিলেন।চারদিকে হৈহল্লা চলছিল। আমার বাবা সন্ধ্যার পর সেই গন্ধময় দূর্বিসহ জায়গা থেকে বের হয়ে রেললাইন ধরে কাঁচিঝুলি আমার ফুফাতো বোন বেগমবুর বাসায় গিয়ে উঠলেন।সেই বাসায় কাজের ছেলে বাসেত ছাড়া আর কেউ ছিল না।দরজা খুলে বাসেত চিৎকার দিয়ে উঠলো ,একি মামা আফনে? কই থ্যাইকা আইলাইন? আফনের শইলে গন্ধ করতাছে।
আমার বাবা শুধু বললো,আগে বাথরুমে যাইতে দে।
৩.
ভোর রাতে আমার বাবা রেল লাইন ধরে গ্রামের বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকলেন।রেল চলাচল বন্ধ। ময়মনসিংহ থেকে সরিষাবাড়ী রেলপথে অনেকগুলো ব্রীজ, কালভার্ট ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যাতে সব জেলায় যাতে না যেতে পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা রেল সড়কপথ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ব্রীজ কালভার্ট ভেঙে ফেলেছে। আমার বাবা আব্দুর রশীদ হাঁটতে হাঁটতে দুইজন বন্ধুকে পেয়ে গেলেন।তারাও পালাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে তাদের পা ফুলে গেছে।তারা সবাই নান্দিনা আমার ফুপুর বাড়ি পৌঁছালেন। আমার বাবাকে দেখে ফুপু তো অবাক।বাবাকে ধরে কাঁদতে থাকলেন।তারপর সবাইকে খাবার দিলেন।বিশ্রাম করে আবার উনারা হাঁটতে শুরু করলেন।
এদিকে রেলওয়ের টরেটক্কা অর্থাৎ সর্ট হ্যান্ড টেলিগ্রামে খবর এলো আমার বাবাকে পাকিস্তানী আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। আমার দাদা রুস্তম আলী সরকার ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বাড়িতে খবর পৌঁছা মাত্র সবাই কান্নাকাটি শুরু করলো।দাদা আমার ছোট কাকাকে ময়মনসিংহে যেতে বললেন।ফারুক কাকা একটি রেলী সাইকেল নিয়ে রওনা হলেন।ফারুক কাকা অনেক কষ্ট করে ময়মনসিংহে পৌঁছলেন। আমাদের বাসা তালা দেওয়া।কলোনীতে সেই সময় বিহারী ষ্টাফ ছাড়া আর কেউ ছিল না।কাকা আমার সহপাঠি আশফাকদের বাসায় গেলেন। আশফাক এর মা কাকাকে সব কিছু বললেন।খেতে দিলেন।বললেন, আমরা কেউ কিছু জানি না।শুধু জানি রশীদ ভাই কে ধরার জন্য পাকিস্তান আর্মী,রাজাকাররা তার বাসা ঘেরাও করছিল।কাকা কান্নায় ভেঙে পড়লো। পরদিন সকালে খবর পেলো মধুপুর দিয়ে রাস্তা চালু হয়েছে।সকাল বিকাল দুইটি বাস যাতায়াত করে টাঙ্গাইল পর্যন্ত।পরদিন কাকা তার সাইকেল আশফাকের বাসায় রেখে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
৪.
ফারুক কাকা সকালের বাসে উঠলেন।বাসটি সার্কিট হাউস মোড় থেকে ছাড়লো।সব সিটেই যাত্রী ছিল।সবাই শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। মধুপুর রসুলপুরে ব্রীজ ভেঙ্গে গেছে।সেটি যাত্রীদের দিয়ে ঠিক করানোর ব্যবস্থা করছে পাকিস্তানি আর্মিরা।মধুপুরে আর্মিদের একটি ক্যাম্প করা হয়েছে।সব যাত্রীদের নামার পর যারা তরুণ তাদেরকে লাইনে দাঁড় করালো।অন্য যাত্রীদের বাসে উঠানোর পর বাস ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিল আর্মিরা। ১৮জনের মতো তরুণ রয়ে গেলো।তাদের দিয়ে ইট নেয়ার ব্যবস্থা করলো।তখন সন্ধ্যা হয়ে এলো সকলকে আর্মি ক্যাম্পে নেয়া হলো।সবাই বুঝতে পারছে আজ আর রক্ষা নেই।১৮ জন তরুণ কে ক্যাম্পের সামনে লাইন ধরে গজারী গাছের সাথে বাঁধা হলো।কারো মুখে কোন কথা নাই।সবাই আতংকে আছে। আমার কাকা তো দোয়া দরুদ পড়ছে।একে তো পেটে কিছু নেই। ইঁদুরের খেলা শুরু হয়ে হয়ে গেছে।তার উপর জীবন মরণ সমস্যা।
৫.
রসুলপুর ক্যাম্পে প্রতি ভোরে বাঙালি তরুণদের হত্যা করা হয়।আজ ১৮ জন তরুণ কে হত্যা করা হবে।পশ্চিমা আর্মীদের সহযোগিতা করেছিল আমাদের পূর্ব বাংলার মানুষ।যারা আর্মীদের সহযোগিতা করেছিল তারাও বাঙালি।আল বদর,আল শামস, রাজাকার এর সদস্য।আমার ফারুক কাকা ভয়ে ভয়ে মরেই যাচ্ছিল।এ যেন মরার আগেই মরে যাওয়া।একজন সৈনিক দেখে গেলো ।ওরা ১৮ জন আছে কিনা? আরো আধ ঘন্টা পর যখন সূর্যের আলো কিছুটা দেখা যাচ্ছে ঠিক সেই সময় তিন চার জন সৈনিক এলো।একজন সবার নাম জিজ্ঞেস করে খাতায় লিখছে।আমার কাকার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো নাম।কাকা নাম বলার সাথে সাথে সৈনিকটি থমকে গেলো।
-কোন? ফারুক?আরে ইয়ার।মেরা দোস্ত! তুম।
কাকার এসব কথা কানেই যাচ্ছে না। মৃত্যুর অপেক্ষায়। শুধু প্রহর গুনছে।
আরেকজন সৈনিক কাকার বাঁধন খুলে দিল।সৈনিকটি লিষ্টের খাতা আরেক সৈনিকের হাতে দিয়ে কাকাকে তাদের ছাওনীতে নিয়ে গেলো।
ময়মনসিংহে আমাদের পাশের বাসার গার্ড সাহেবের বড় ছেলে আলিম। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আলিম আর্মীতে যোগ দিয়ে ছিল।আলিম আর ফারুক কাকা কায়েদা মিল্লাত স্কুলে ১০ ম শ্রেণিতে পড়তো।কাকা না চিনলেও আলিম চিনেছিল।রাখে আল্লা মারে কে।আলিম কাকাকে যখন নাস্তা (পরাটা গরুর মাংস) খাওয়াচ্ছে ঠিক তখন গুলির আওয়াজ শুনলো কাকা।এর ঘন্টা খানেক পর আলিম একটি ট্রাকে কাকাকে উঠিয়ে দিয়েছিল।
আমার আব্বা বাড়ি পৌঁছানোর পর সবাই কান্না শুরু করে দিল।এদিকে ফারুক কাকাও বাড়ি ফিরে এলো।
আব্বা কদিন পর আবার ময়মনসিংহে চলে গেলেন। আওয়ামীলীগ নেতা রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া, মোঃ শামসুল হক, প্রিন্সিপ্যাল মতিউর রহমান সহ অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে রেলওয়ে কলোনির তরুণ ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে থাকলেন।উনারা দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে রাতে কাজ করতেন।
৬.
দেশ স্বাধীন হবার পর ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য মনটা পাগল হয়ে যাচ্ছিল। একদিন বেগমবুবু তার মেয়েদের নিয়ে ময়মনসিংহে যাচ্ছে শুনে আমি আম্মার কাছে বায়না ধরলাম বেগমবুর সাথে আমিও ময়মনসিংহে যাবো। জগন্নাথগন্জ রেল ষ্টেশন থেকে জিএম ট্রেন ছেড়ে ময়মনসিংহ যায়। সকাল ৮টায় সরিষাবাড়ী থেকে আমরা উঠলাম।রেল কলোনীতে আমার সহপাঠি বন্ধুরা কে কেমন আছে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছিল।অমি,আশফাক,জামান,সিদ্দিক, সেলিম ,আতিকদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। দুপুর ১টায় ময়মনসিংহ রেলওয়ে ষ্টেশনে ট্রেন থামলো।আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে আব্বার অফিসে গেলাম।আব্বার কলিগ আমাকে দেখেই বললো, তোমার আব্বা রেল লাইনের দক্ষিণ পাশে দোতলা বিল্ডিং এ থাকে।আমি ঠিক চিনেছিলাম।একা একা চলে গেলাম।বেগমবু হয়তো আমাকে খুজেছিল।দোতলা বিল্ডিং এর সামনে গিয়ে আমার মনটা ভরে গেলো।ছাদে একটি লম্বা বাঁশের আগায় বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকানো লাল সবুজের পতাকা উড়ছিল।আমি দরজায় নক করলাম।একটি ছেলে দরজা খুলে দিল।আব্বার নাম বলতেই জিগ্যেস করলো, তুমি স্যারের পোলা? আমি মাথা নাড়লাম।ও আমাকে দোতলায় নিয়ে গেলো ।আব্বা আমাকে দেখে অবাক।আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।ছেলেটিকে বললো, ওকে খেতে দে।হাওড়ের বিরাট বড় কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেলাম।আব্বা আমাকে মৃদু শাসন করলো।তোর বেগমবুকে না বলে আসা ঠিক হয়নি।
বিকেল বেলা আমার চিরপুরাতন রেল কলোনীতে গেলাম।বন্ধুদের সাথে দেখা হলো।ওদের কাছে জানলাম আমাদের বাসা লুট হয়ে গিয়েছিল।আব্বা পরদিন আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। গার্ড কাকুর রুমে বসে চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ী। বাসা ঠিক করে আমাদের খুব শিঘ্রী ময়মনসিংহে নিয়ে যাবেন।
দেশ স্বাধীনের পর আব্বা খুবই ব্যস্ত ছিলেন।আব্বা ময়মনসিংহ রেলওয়ে সেক্টরে রেডক্রসের সদস্য নির্বাচিত হলেন।অনেক সাহায্য সহযোগিতা রেডক্রসের নিকট থেকে পেয়েছিলেন।যা রেলওয়ে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মাঝে বিতরণ করেছেন।
বাড়ী থেকে এসে বন্ধুদের নিয়ে শহরের অলি গলিতে ঘুরে বেড়াতাম। কত মানুষের লাশ মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল পাকবাহিনী।সারা শহরেই যেনো মৃত্যু কূপ তৈরীর করেছিল।চারিদিকেশ শুধু লাশের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল।।পশ্চিমা বাহিনীর তৈরি রাজাকার,আলবদর,আল শামস বাহিনী নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে,নারীদের নির্যাতন করেছে, লুট করেছে,ঘরে ঘরে আগুন দিয়েছে।এ ক্ষতি কখনো পুরন হবার নয়।
অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখন্ড যার নাম বাংলাদেশ, একটি লাল সবুজের পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত-“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি—।
#
লেখক: সম্পাদক, ত্রৈমাসিক মহুয়া,
সদস্য, বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটি,
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।